
সময়টা উনবিনশ শতাব্দী, ঘটে গেছে তুমুল আমূল পরিবর্তন সর্বস্তরে। রাজনৈতিক স্তরে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের জন্ম । National Congressএর প্রতিষ্ঠা ১৮৮৫। সামাজিক স্তরে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন, যুগান্তকারি আইনসমূহ, নারীশিক্ষার অগ্রগতি ও বিকাশ।সাহিত্যগত স্তরে একটা আলালের ঘরের দুলাল বা একটা হুতোম প্যাঁচার নকশা ।বিরাট বিপুল পরিবর্তন বাঙ্গালীর ভাবনায়, চিন্তায়, পোশাকে, খাদ্যাভাসে, জীবনাচরণে।
বাংলার ইতিহাসে পলাশী যুদ্ধকে একটা সন্ধিক্ষণ (১৭৫৭) বলে ধরা হয় । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ও তৎকেন্দ্রিক জীবনাচরণ থেকেই বাঙ্গালী জীবনে সর্ববিধ পরিবর্তনের সুত্রপাত। কিন্ত আদত বাংলাদেশের নদীকেন্দ্রিক জীবনের আটপৌরে রীতির যে জীবনযাপন তা এখনকার দেখতাই জীবনের থেকে অনেকটাই ধাঁচে সাদামাটা । রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখছেন ‘কাপড় চোপড় অতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের চোখে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে। বয়েস দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনদিন কোন কারনেই মোজা পরি নাই। শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আরেকটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল।’ কিন্তু ক্রমশ এই simplicity র বদল ঘটল। শরৎচন্দ্রের ‘নিষ্কৃতি’ উপন্যাসেরই কথা ধরা যাক। ভবানীপুরের চাটুজ্যে পরিবারে তুতভাই অতুলের আগমন। বাড়ীর অন্য ছেলেদের তথাকথিত ‘simple’ পোশাক দেখে তার কি বিদ্রূপ। অর্থাৎ বিদেশীয়ানার ধাঁচ এসেছে কিন্তু তা সর্বত্রপ্রসারী তখনো হয়নি । কীরকম এই পরিবর্তিত কেতাদুরস্ত পোশাক? যে রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেন ‘মনে তার নিত্য আসাযাওয়া, পরনে ঢাকাই শাড়ি , কপালে সিঁদুর’ আবার ঔপনিবেশিক খোলা হাওয়ার ছোঁয়ায় তাঁরই ‘শেষের কবিতার’ কেতকী বা কেটি লাবন্যের একেবারে বিপরীতে অবস্থান করে। শরৎচন্দ্রের দত্তা, গৃহদাহের অচলা – বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাকে আশাকে পরিবর্তনের আরেক ছোঁয়া এনে দেয় ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শ ।
আমাদের দেশে আমরা আজকাল যে শাড়ি পরার ধরন দেখি তা কিন্তু বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব রীতি নয়। বাংলাদেশের তথাকথিত traditional রীতিটি কিন্তু কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা নয়। রীতিটি ছিল এইরুপ – কোমরের ডান দিক থেকে বাঁ দিকে, ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দ্বিতীয়বার ঠিক তার বিপরীত দিক দিয়ে কোমরের বাঁ দিক থেকে ডান দিকে শাড়ি ঘুরিয়ে গুঁজে তারপর আলগা দীর্ঘ আঁচল বাম কাঁধের কাছে জড়ো করে রাখা হয়। এই কাঁধের কাছে রাখা আঁচল এতটাই বড় যে তা দিয়ে চমৎকার মাথায় ঢাকাও (ঘোমটা) দেওয়া যায়ে। যামিনী রায়ের বিখ্যাত চিত্র মাতৃমূর্তিতে এই আটপৌরে শাড়ি পরা ছবিটি দেখি আমরা। অধুনা প্রচলিত কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরার রীতিটি বাংলাদেশে প্রচলিত করেন জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী । একটু বিস্তৃত ভাবে বলা যাক। বাংলার আই সি এস, রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যখন বোম্বাইতে (মুম্বাইতে) থাকতেন তখন সেখানকার পারসী রীতিতে শাড়ি পরার চল দেখে তিনি তা আয়ত্ত করেন এবং বাংলাদেশে তা প্রবর্তন করেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বঙ্গ রেনেসাঁর অন্যতম পীঠস্থান । জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। এই ধরনের শাড়ি পরার রীতিতে কোমর থেকে পেটিকোট বা সায়া এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে ব্লাউজ বা সেমিজ পরার রীতিও প্রচলিত হল। তখন থেকেই এই যে রীতি শুরু হয়েছিল তা আজও প্রচলিত। এর আগে সায়া সেমিজ রীতির প্রচলন ছিল না। তাই সায়া সেমিজ পরার প্রচলনটা সহজ হয়নি। বাঙ্গালী ললনা সমাজের উদ্দেশ্যে সেদিন রক্ষণশীলদের যথেষ্ট টীকাটিপ্পনী বর্ষিত হয়েছিল। তবে প্রাকৃতিক নিয়মেই কালের রথ থামানো যায়নি ।
পুরুষের পোশাক পরিবর্তনের প্রসঙ্গে আগেই বলা হয়েছে। পুরুষদের ধুতি, ফতুয়া, চাদর, আলোয়ানের জায়গা নিল প্যান্টশার্ট,কোট, হাতে ছড়ি, চুরুট বা সিগার। মাঝে ‘বাবু’ কালচার কলকাতার শৌখিন, বিত্তবান, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে গ্রাস করে ছিল। তাদের বুদ্ধিজীবী চর্চার সংগে সংগে অতিরিক্ত মদ্যপান সহ সাহিত্য, সঙ্গীত চারুকলার চর্চা এবং অর্থের অপচয় আজ গল্পবস্তুর উপকরণ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাবু’ প্রবন্ধে এরকম এক চমৎকার বর্ণনা আমরা পাই – ‘যাহারা চিত্রবসনাবৃত , বেত্রহস্ত, রঞ্জিতকুন্তল এবং মহাপাদুক, তাহারাই বাবু’। বাবুদের সৃজিত এই ‘style icon’ যে আজ পুরপুরি হারিয়ে গেছে তা নয় কিন্তু। আজ মাত্রায় কম হলেও ধাক্কা পাড়ের চুনট করা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, নাগড়াই জুতো আজো যে একেবারে দেখা যায়না তা নয় ।
অতি সম্প্রতিকালে এই বঙ্গ জীবনের ধারাও পরিবর্তিত । আজকের global দুনিয়ায়ে ফ্যাশানও global। পুরুষ নারী নির্বিশেষে জিন্সের পোশাক বাজারের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে। এর সঙ্গে রয়েছে সিনথেটিক বিভিন্ন সামগ্রী । পুরুষ বা নারী – সবাই প্যান্ট বা trousers, টি–শার্টে সমানে স্বচ্ছন্দ। মেয়েদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সংযোজন স্কারট, সালওয়ার কামিজ ইত্যাদি। বিশেষ উৎসবে পুরুষদের শেরওয়ানী, মেয়েদের ঘাগরাচোলী পরার প্রবণতাও চোখে পড়ার মত। লক্ষণীয় বিষয় হল কিছু পুরনো জিনিস ফিরিয়ে আনার প্রবণতা। এখন বাংলার বাজারে মেয়েদের খুব পছন্দসই শাড়ির তালিকায় রয়েছে মসলিন, জামদানী, ঢাকাই, বালুচরী প্রভৃতি শাড়ির পাশাপাশি গরদ,মুরশিদাবাদি সিল্ক সহ অন্যান্য বিবিধ ধরনের সিল্ক, তাঁত (ধনেখালি, ফুলিয়া) বা সুতীর শাড়ি (মলমল জাতীয়)। ব্যবহারে বেড়েছে সিনথেটিক, শিফন, জর্জেট এবং বিভিন্ন নতুন উপাদানে তৈরি শাড়ি। বিভিন্ন প্রিন্টের বাহার, মধুবনি পেন্টিং, কলমকারি কাজ; আবার পুরানের দেবদেবী বা চরিত্র সম্বলিত বালুচরী শাড়ির নক্সা, কাঁথা স্টিচের অসংখ্য মোটিফ। ব্লক প্রিন্ট, ঝাড় প্রিন্ট – কত না বাহার। পাটজাত বস্ত্র ( যা প্রাচীন ভারতে পাটবস্ত্র বলে উল্লিখিত) ফিরে এসেছে নতুন মহিমায়। জুট সিল্ক, ঘিচা এই গৌরবে নবতর সংযোজন । হয়ত আজকের দিনে পাওয়ারলুমের ক্রমবর্ধমানতায় হ্যান্ডলুম পিছিয়ে পড়েছে, বহুবিধ পোশাকের ভিড়ে শাড়ির দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার যোগ্যতা প্রশ্নের মুখোমুখি। তবু আজও শাড়ি বাংলার তথা ভারতবর্ষের মুখ; ঠিক যেমন ধুতি ভারতবর্ষের সবচেয়ে ট্র্যাডিশনাল পোশাক।
ধুতিকে ঐতিহাসিক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী। তেমনি ভারতবর্ষের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বা ইতালীয় কন্যা ভারতবর্ষের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সোনিয়া গান্ধী জনসমক্ষে বা দেশের প্রতিনিধিত্বের সময় শাড়িকেই ব্যবহার করেছেন।বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। সম্প্রতিকালে ধুতি পরার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখাগেছে। এখন স্টিচড ধুতি পাওয়া যায়ে যা পরার ক্ষেত্রে খুব সুবিধেজনক । ধুতির সংগে বরাবরই কুর্তি (ফতুয়া জাতীয়) ব্যবহার করা হত। এখন আধুনিক ডিজাইনের কুর্তির বহুল সম্ভার। খাদি থেকে সুতির বা বহু মূল্যবান সিল্কের নানা ধরনের কুর্তি। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বা উজ্জল খ্যাতিমান পুরুষদের এই পোশাকের ব্যবহার ধুতি কুর্তিকে গরিমাময় করে তুলেছে। না বলে পারছিনা। সম্প্রতিকালে ভারতবর্ষ সফরে এসেছিলেন নব নির্বাচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। প্রথম কালীন সফরে মাল্যচন্দনে ভূষিত অতিথিকে ভারতবর্ষীয় প্রথায় সম্বর্ধিত করার সময় তার পরনে যে পোশাকটি শোভা পাচ্ছিল তা কিন্তু শাড়ি।
সংস্কৃতি বহতা ধারা। আহরণ বর্জনের মধ্যে দিয়েই তার অগ্রগতি। বাঙ্গালির পোশাকের বিবর্তনের ধারাটিও এর ব্যতিক্রম নয়।
Very informative and excellent reading
Thanks Arindam for your encouraging words.